নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নদী বষ্টিত উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতে গত এক মাস ধরে ডায়রিযার ভয়াবহ প্রকোপ চলছে। এখন যদিও পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ার কারণ খুঁজতে গবেষণা চালাচ্ছে দু’টি পৃথক গবেষণা দল। সরকারের রোগতত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধি দল জানিয়েছেন ৭৪ শতাংশ মানুষ নদী ও খালের পানি ব্যবহার করার কারণে ঝালকাঠিসহ দক্ষিণাঞ্চলে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এ প্রতিনিধি দলটি রোববার বিকেলে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ডায়রিয়া রোগী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং রোগীদের মল, খালের পানি ও বিভিন্ন উৎসের নমুনা সংগ্রহ করেন। এদিকে ঝালকাঠি জেলায় গত এক সপ্তাহ ধরে ডায়রিয়ার যে ভয়াবহতা শুরু হয়েছিল, তা কিছুটা কমতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে সোমবারও সদর হাসপাতাল ও তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুই শতাধিক ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। গত ১৫ দিন ধরে হাসপাতালগুলোতে এ রোগে আক্রান্ত ৩ হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি ছিল। করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টির হয়েছে। ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল, নলছিটি, রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিদিন গড়ে ৫ শতাধিক রোগী ভর্তি ছিলেন। গত দুই দিন ধরে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। ঝালকাঠি জেলায় বিগত ১০-১২ বছরের মধ্যে বর্তমানে চলমান ডায়রিয়ার ব্যাপকতা দেখা যায়নি। তবে এখনো পুরোপুরি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি বলেও জানান তিনি। হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকটের কারণে এখনো রোগীরা বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। জেলায় করোনাভাইরাসের সিমটমের মধ্যে ডায়রিয়াও অনন্য উপসর্গ। এজন্য ডায়রিয়া রোগীদের মধ্যে করোনা পরীক্ষার জন্য প্রাথমিকভাবে ১০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে বরিশাল শেবাচিম করোনা ইউনিটের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে এবং তাদের সকলের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। মঙ্গলবার আরও ১০ জনের কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত কি-না নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য বরিশাল করোনা ইউনিটের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, ঝালকাঠি জেলায় ১ এপ্রিল ২০২১ তারিখ থেকে রোববার (২৫ এপ্রিল) পর্যন্ত ৪৩৫৭ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় ২২২৩ জন, নলছিটি উপজেলায় ৬৬৩ জন, রাজাপুর উপজেলায় ৮১৬ জন ও কাঠালিয়া উপজেলায় ৬৫৫ জন সুস্থ হয়ে চলে গেছেন এবং বর্তমানে ২০৯ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও বয়স্ক। বিছানার অভাবে অনেকেই হাসপাতালে এসে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। এ অবস্থার মধ্যে স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে। ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডাক্তার জাফর আলী দেওয়ান বলেন, প্রতি বছর এপ্রিল ও মে মাসে ডায়রিয়াজনিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। প্রচন্ড গরম, অনাবৃষ্টির কারণে ঝালকাঠিতে বেড়েছে ডায়রিয়া। নদীর পানি নোনা, খালের পানিতে মলের জীবানু, খাবারে বিষক্রিয়া। এ সময় প্রচ- গরম ও নদীতে লবণপানি চলে আসে। নদী তীরবর্তী বা ঝালকাঠি শহরের মানুষই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিচ্ছি। তিনি আরো জানান, ডায়রিয়া রোগীদের জন্য মুখে খাওয়া স্যালাইন পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে কলেরা স্যালাইনের সরবরাহ একটু কম থাকায় পর্যাপ্ত দিতে পারছি না। এ ছাড়া বেডের স্বল্পতা থাকায় সবাইকে বেড দিতে পারছি না। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিযন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিনিধিদল ঝালকাঠি বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তালিকা ধরে সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষাভুক্ত এলাকায় মাত্র ২০ শতাংশ বাড়িতে গভীর নলকূপ আছে। প্রতিষ্ঠানটি ঝালকাঠির খালের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করে খালের পানিতে মলের জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে। ২০ জন রোগীর মল পরীক্ষায় তিনজনের মলে কলেরা ও ইকোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া বিষয়টি সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ঝালকাঠি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এর মধ্যে খাওয়ার ও গৃহস্থালি কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ানো, খাল-নদীর পানি ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করে ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া। ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডা. রতন কুমার ঢালী জানান, আচমকা এই ডায়রিয়ার প্রকোপ জেলা জুড়ে বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইন মজুত শেষ হয়ে আসছে। ঢাকায় অধিদপ্তরে আইভি স্যালাইনের জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় জেলাজুডে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপদ পানির ব্যবহার নিযে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পানিতে লবণাক্ততা বেডে যাওয়া, খালে ও নদীর পানিতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়া, অস্বাস্থ্যকর খাবার, অনাবৃষ্টির কারণে হঠাৎ ঝালকাঠি জেলায় ডায়রিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা: বাসুদেব কুমার দাস জানান, জাতীয় রোগ তত্ত্ব ও গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) থেকে টিম এসে পরিস্থিতি দেখে কিছু কারণ উদঘাটন করেছে।’ তিনি আরো বলেন, এখনো আইইডিসিআরের একটি দল বরিশাল অঞ্চলে এ নিয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, আইইডিসিআরের বিশ্লেষকরা অনেক দিন ধরে সবকিছু দেখেছেন ও তারা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করছেন। তবে এটা পরিষ্কার যে লবণাক্ত পানিতে জীবাণু বেশি সময় ধরে টিকে থাকে। আর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ খাবারের জন্য গভীর নলকূপ আর গৃহস্থালি কাজের জন্য পুকুর, খাল কিংবা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। বাসুদেব কুমার দাস বলেন, এসব পানিতে জীবাণু পেয়েছেন ঢাকা থেকে আসা গবেষকরা। তবে তারা এখনো এসব নিয়ে কাজ করছেন। ডায়রিয়া পরিস্থিতি স্যালাইন সঙ্কট মোকাবিলায় অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কয়েক দিনের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর জন্য ৩৫ হাজার স্যালাইন যাবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। তিনি আরো বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় জেলাজুডে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপদ পানির ব্যবহার নিযে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। নদী তীরবর্তী এলাকায় সচেতনতার লক্ষে মাইকিং করা হচ্ছে।
Leave a Reply